একীভূত হবে দুর্বল ব্যাংক, রাজনৈতিক পরিচয়ে ছাড় পাবে না খেলাপি

Passenger Voice    |    ০৩:৩৪ পিএম, ২০২৪-০২-০১


একীভূত হবে দুর্বল ব্যাংক, রাজনৈতিক পরিচয়ে ছাড় পাবে না খেলাপি

সাহসী সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকের মার্জারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম দফায় দুর্বল ব্যাংককে সতর্ক, এরপর উন্নতি না হলে অন্য একটি ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত (মার্জার) করা হবে। আর খেলাপিদের ধরতে কোনো বাছবিচার হবে না, দেখা হবে না কোনো রাজনৈতিক পদ পরিচয়। এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

বুধবার (৩১ জানুয়ারি) ব্যাংকার্স সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। 

বৈঠকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ডলার লেনদেনের নতুন পদ্ধতি ক্রলিং পেগ বাস্তবায়ন, কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে ধার দেওয়া, প্রোমোট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে প্রস্তুতি নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর মামলায় আটকে থাকা বিপুল অঙ্কের খেলাপির টাকা আদায়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ওই বৈঠকে।

ব্যাংকার্স সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সভাপতিত্ব করেন। এতে দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা অংশ নেন। পরে সভা শেষে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক। 

দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপি ও নানা অনিয়মের কারণে বেশ কিছু ব্যাংক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। কোন কোন ব্যাংক সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে, এর তালিকা প্রকাশ না করলেও সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব ব্যাংকের তালিকায় ৪র্থ প্রজন্মের ব্যাংকও রয়েছে। 

এসব ব্যাংক বাছ–বিচার ছাড়াই বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। গ্রাহকের আমানতের টাকা নির্বিচারে ঋণ দেওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চরমে। অনেক ক্ষেত্রে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে তারল্য সহায়তা নিতে হচ্ছে। 

ঋণ খেলাপের কারণে প্রায় ডুবতে বসা ব্যাংকের উদাহরণ হলো সাবেক ফারমার্স ব্যাংক, বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক। ব্যাংকটিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় কয়েকটি ব্যাংক থেকে তারল্য জোগানোর মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয় কয়েক বছর আগে। ব্যাংকটি এখনো ঝুঁকির বৃত্ত ভাঙতে পারেনি। এ রকম আর কোন কোন ব্যাংক ঝুঁকিতে রয়েছে, সেটি নিয়ে কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সংস্কারের জন্য প্রোমোট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) নীতিমালা জারি করা হয়েছে। সেখানে সংস্কারের ক্ষেত্রে কীভাবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা নির্ণয় করা হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট বর্ণনা দেওয়া আছে। যেকোনো বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকের হিসাব ধরে পরবর্তী বছরের মার্চ ব্যাংকগুলোর চারটি ক্যাটাগরির ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘এ জন্য ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের ব্যক্তিগত ভাবে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। আর যেসব ব্যাংকের অবস্থা একেবারেই দুর্বল তাঁদের ঋণ বিতরণ, আমানত সংগ্রহ থেকে শুরু করে কার্যক্রমের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। কোনো ব্যাংকের অবস্থা ক্রাইটেরিয়া পূরণে ব্যর্থ হলে সেই ব্যাংক বিধিমালার আলোকে একীভূত (মার্জার) করা হবে, তবে এই সময়ের মধ্যে ব্যাংকগুলো যদি তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করতে পারে তাহলে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা আসবে না।’ 

বৈঠকে আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে ব্যাংকার্স মিটিংয়ের বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। সেখানে ব্যাংক মার্জারসহ পিসিএ, ক্রলিং পেগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ দুর্বল ব্যাংকগুলো যাতে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে মার্জ করা যায়, সেটির বিষয়ে কথা হয়েছে। বৈঠকে গভর্নর পলিটিক্যালি যেই হোক না কেন সুশাসন ফেরাতে কোনো ছাড় না দিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। কোন ব্যাংককে কীভাবে মার্জ করতে চান সে বিষয়ে বলেছেন। তাতে আগামীতে ব্যাংকিং সেক্টর ঘুরে দাঁড়াবে।’ 

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী ব্যাংকিং পরিচালনা হবে। ব্যাংকে সুশাসন ফেরাতে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সবকিছুই করতে গভর্নর কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া খেলাপিদের ধরতে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।’ 

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার পদক্ষেপের অংশ হিসেবে মার্জার ও ব্যাংক সুশাসন বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকে শৃঙ্খলা ফেরানোর খবরকে সাধুবাদ জানাই। খেলাপিদের রাজনৈতিক ছাড় না দিলে খেলাপি কমবে। এখন প্রকৃত খেলাপি ২৫ শতাংশ। তা কমে আসবে। তখন তারল্য বাড়বে। তবে এটা দেরি হয়ে গেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক ধরে আগাতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিক ধরলে কার্যকর হবে ২০২৫ সালের মার্চে। তবে সেটাও ভালো। তবে করবে কি না তা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।’ 

দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার পাশাপাশি ঋণ খেলাপিদের ধরা, ডলার সংকট কাটাতে ক্রলিং পেগ বাস্তবায়ন ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়েও ব্যাংকারদের কড়া নির্দেশনা দিয়েছেন গভর্নর। 

এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি সংকোচন মূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছি। সেখানে টার্গেট বাস্তবায়ন পর্যন্ত এই ধরনের মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সংকট দেখা দিতে পারে। এ জন্য তাদের আগে থেকেই সতর্ক থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। যাতে তারা তারল্য ব্যবস্থা ঠিক করতে পারে। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাংকের সুশাসন ফিরাতে চাই। এ জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় মার্জার ইকুইজিশন করেছি।’ 
 
তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যাংকের সুশাসন ফেরাতে একটি কমিটি গঠন করেছি। তারা একটি অ্যাকশন প্ল্যান ঠিক করে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করবে। পরে সেই অনুযায়ী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে। সেখানে খেলাপি ঋণ কমানো এবং সুশাসনের নিশ্চিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার সন্নিবেশ করতে নির্দেশনায় জোর দেওয়া হয়েছে। ডলার ব্যবস্থাপনায় ক্রলিং পেগ চালু করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার রেখে কারেন্সি সোয়াপ করা হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে সেটি বাস্তবায়ন করা হবে। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের ক্রলিং পেগ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে।’ 

মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের সুদের হার আরও বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো যাতে কোনো ধরনের সমস্যায় না পড়ে সে বিষয়ে তাদের আগে থেকেই পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ডলার সোয়াপে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ডলার আছে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা দিয়ে প্রয়োজন হলে ডলার রেখে টাকা নিতে পারবে। সময় শেষে টাকা ফেরত দিয়ে ডলার ফেরত নিতে পারবে। যেসব ব্যাংকের কাছে শর্তের অতিরিক্ত ডলার থাকে। সে ক্ষেত্রে শর্তের কারণে তারা সেই ডলার বিক্রি করে দিতে হয়। আবার পরবর্তীতে তাদের প্রয়োজনে ব্যাংকগুলো ডলার পাচ্ছে না। এ জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক কারেন্সি সোয়াপের দিকে যাচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের চর্চা আছে। এর আগে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হয়নি। তাই চর্চা ছিল না।’ 

মেজবাউল হক বলেন, ‘আদালতে আটকে থাকা অর্থ মামলা কমাতে এডিআরের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ব্যাংক নির্বাহীদের। এতে মামলার সংখ্যা কমে আসবে। তাঁদের সতর্ক করা হয়েছে যেন কোনো গ্রাহক এই এডিআরের সুবিধা নিয়ে কালক্ষেপণ না করতে পারে।’ 

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আইএমএফ তাদের দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার করার পদক্ষেপ নিতে বলেছে। সে ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার মাধ্যমে গুণগত মান বাড়ানো অন্যতম। তবে ব্যাংক একীভূত করার মতো হুঁশিয়ারি ও ঋণ খেলাপি ধরার জন্য যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, এটির বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


প্যা/ভ/ম